বাংলা মানে শুধু একটি ভাষা নয়, এটি একটি সম্পূর্ণ সভ্যতা। একদিকে বাংলাদেশের বাঙালি, অন্যদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি—দু’জনেই এক ভাষায় কথা বলে, এক সংস্কৃতি বহন করে, এক ঐতিহ্যে গড়ে উঠেছে। ভৌগোলিক সীমারেখা আলাদা হলেও, বাংলা ভাষা আমাদের এক করে রাখে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের নোবেল জয়, নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা, কিংবা সুকুমার রায়ের রসিকতা—সবই এই বাঙালি জাতিসত্তার অংশ। তাই বলা যায়, বাংলা ভাষা হলো আমাদের আত্মপরিচয়ের শিকড়, আর বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলেই হলো বাঙালি জাতির পূর্ণ রূপ।

বাঙালি কারা?

বাঙালি হলো সেই জাতি যারা বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহার করে, এবং যাদের সংস্কৃতি, সাহিত্য, সংগীত, খাবার, পোশাক, উৎসব—সবই বাংলা ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে।

  • বাংলাদেশ: প্রায় ১৭ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। স্বাধীনতা যুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, এবং সাংস্কৃতিক চেতনা—সবকিছুই এখানে বাংলার মর্যাদা রক্ষায় ভূমিকা রেখেছে।
  • পশ্চিমবঙ্গ (ভারত): প্রায় ১০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। কলকাতা, শান্তিনিকেতন, দার্জিলিং থেকে সুন্দরবন—সবখানেই বাংলা সংস্কৃতির ছাপ পাওয়া যায়।

কেন হিন্দিভাষীরা বাংলার বিরোধিতা করে?

ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দির আধিপত্য চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ফলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বহুবার প্রতিবাদ করেছে। অনেক হিন্দিভাষী মানুষ মনে করেন, হিন্দিই ভারতের একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত।

কিন্তু বাস্তব হলো, ভারত বহুভাষী দেশ, এবং বাংলা ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা। তাই যখন বাংলাকে অবহেলা করা হয়, তখন বাঙালি হিন্দি আধিপত্যকে মেনে নেয় না।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে দমন করতে চেয়েছিল। ১৯৪৮ সালে যখন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব আসে, তখনই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন।

অর্থাৎ, দু’পারের বাঙালি—বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গ—ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একই রকম দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে।

বাংলা ভাষার গৌরব

  1. ভাষা আন্দোলন (১৯৫২, বাংলাদেশ)
    পৃথিবীর একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বাররা প্রমাণ করেছিলেন—ভাষা পরিচয়ের চেয়ে বড় কিছু নেই।
  2. সাহিত্য
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (নোবেলজয়ী কবি, পশ্চিমবঙ্গ)
    • কাজী নজরুল ইসলাম (জাতীয় কবি, বাংলাদেশ)
    • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সেলিনা হোসেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ—সবাই বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছেন।
  3. সংস্কৃতি ও সংগীত
    রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, বাউল, আধুনিক, লোকগান—সবই বাঙালির সংস্কৃতির অমূল্য অংশ।
  4. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
    ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, পশ্চিমবঙ্গসহ পুরো বিশ্বের বাঙালির গর্ব।

কেন বাঙালি ভাষা নিয়ে গর্বিত ?

  • বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ভাষা (৩০ কোটিরও বেশি মানুষের ভাষা)।
  • সাহিত্য ও শিল্পে অবদান—রবীন্দ্রনাথের কবিতা, নজরুলের গান, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস, সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র।
  • ভাষার জন্য জীবনদানের ইতিহাস—যা পৃথিবীতে বিরল।
  • অদম্য সাংস্কৃতিক ঐক্য—ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত হলেও, ভাষায় এক।

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ: ভিন্ন রাষ্ট্র, এক সংস্কৃতি

  • বাংলাদেশ: লাল-সবুজ পতাকা, স্বাধীনতার সংগ্রাম, বীরত্বের ইতিহাস।
  • পশ্চিমবঙ্গ: দুর্গাপূজা, শান্তিনিকেতন, কলকাতার সাহিত্যচর্চা, আধুনিক শিল্প আন্দোলন।

দুই জায়গার খাবারেও মিল—ইলিশ মাছ, ভাত, মিষ্টি, পান্তা-ইলিশ কিংবা রসগোল্লা—সবই বাংলার পরিচয় বহন করে।

আমাদের করণীয়

  1. ইন্টারনেটে বাংলার ব্যবহার বাড়ানো।
  2. শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া।
  3. হিন্দি বা ইংরেজি শিখলেও, বাংলার প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রাখা।
  4. সাহিত্য, গান, নাটক, চলচ্চিত্রে বাংলার প্রভাব বজায় রাখা।

উপসংহার

বাংলা জাতিসত্তা শুধু একটি ভূগোল নয়, এটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে এক অদম্য শক্তি। অন্য ভাষাভাষীরা যখন বাংলাকে ছোট করতে চায়, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে—আমরা সেই জাতি যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, সাহিত্য দিয়ে বিশ্ব জয় করেছে, সংস্কৃতির মাধ্যমে অমর হয়ে আছে।

বাংলা ভাষা আমাদের পরিচয়, আমাদের গর্ব, আমাদের ঐক্যের শক্তি। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ—দু’পারের বাঙালি একসঙ্গে থাকলেই বাংলা জাতিসত্তা পূর্ণতা পায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts